পসেসিভ
-মুনমুন রাহা
ঘরের লাগোয়া এক চিলতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল পৌলমী । ছোট্ট বারান্দা থেকে রাতের সীমাহীন বিশাল আকাশটাকে দেখতে বেশ লাগছে। মনটা এই অসীমতায় ছড়িয়ে দিয়ে বড় করে একটা নিশ্বাস টানল সে। অন্য দিন পৌলমীর মনের সব ঝড় এতেই কমে যায়। কিন্ত আজ তা হল না। আসলে আজকের মনের ঝড়টা বেশ বড় আকার ধারন করেছে। এই ঝড় এত তাড়াতাড়িই বোধহয় বিলীন হওয়ার নয়।
‘পসেসিভ’ কথাটাতে আগে বেশ গর্ব অনুভব করত পৌলমী । বিয়ের পর পর যখন আত্মীয়রা বা বন্ধুরা এক মুখ দুষ্ট হাসি নিয়ে বলত, ” তোর বর তোকে নিয়ে ভারী পসেসিভ”, তখন বেশ ভালোই লাগত পৌলমীর। কিন্ত আস্তে আস্তে সলিলের পসেসিভনেসটা সন্দেহ বাতিকে পরিবর্তন হয়েছিল। বিয়ের নতুনত্ব কাটতে না কাটতেই এই বাতিকের জেরে হাঁপিয়ে উঠেছিল পৌলমী। অফিসের কোন পুরুষ কলিগ দরকারে ফোন করলে সন্দেহ , কোন অনুষ্ঠান বা পার্টিতে কোন পুরুষের সাথে হেসে কথা বললে সন্দেহ। পাড়া প্রতিবেশিরদের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা ছিল না। প্রথম প্রথম পৌলমী সলিল কে বোঝাত। চাকরি সলিলও করে তাই তার বোঝা উচিত অফিসের কলিগ কাজের জন্য ফোন করতেই পারে , সেখানে নারী পুরুষের পার্থক্য হয় না। আর তাছাড়াও সমাজে থাকলে সামাজিকতাও করতে হয়। বন্ধু , আত্মীয় এদের সাথে সম্পর্ক রাখাও এক প্রকারের সামাজিকতা । কিন্ত সলিলকে হাজার বুঝিয়েও কাজ হয় না।
একবার পৌলমী অফিস থেকে সবে ফিরেছে , সলিল তখনও ফেরে নি। পৌলমীর শাশুড়িমা গেছেন গুরুদেবের আশ্রমে । এমন সময় সলিলের জাঠতুত ভাই সমীর এসে হাজির। পৌলমী যথা সম্ভব অথিতি আপ্যায়ন করেছে । এদিকে কিছুক্ষণ পরেই সলিল এল অফিস থেকে , এসে পৌলমী আর সমীরকে বাড়িতে একা দেখেই মুখ ভার করে চলে গেল ঘরে। তারপর রাতে পৌলমী ঘরে আসতেই সমীর আর পৌলমীকে নিয়ে নানা বাজে কথা বলতে লাগল। আরও অদ্ভুত ব্যাপার , সব কিছু শুনেও পৌলমীর শাশুড়ির মত হল, এ নাকি তার ছেলের বৌয়ের প্রতি ভালবাসা । সেদিন রাতে পৌলমী ঠিক করেছিল সকালে উঠেই চলে যাবে বাপের বাড়ি। কিন্ত সকালে উঠে আর যেতে পারে নি সে , কোথায় যেন সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা তাকে পিছু টেনেছিল। তবে সেদিনের পর থেকে সলিলকে সে আর কিছু বোঝাতে যেত না। পৌলমীর মনে হয়েছিল সলিলের এই অসুখের চিকিৎসা তার দ্বারা সম্ভব নয়।
এসব কিছুর পরেও সমাজের শৃঙ্খলতায় আর সম্পর্কের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ হয়ে পৌলমী সলিলের সাথে কাটিয়ে দিয়েছে চার চারটে বছর। আজ ভারী খুশি ছিল পৌলমী । ডাক্তার যখন তার প্রেগনেন্সি কনফার্ম করে তখন হঠাৎই মনের ভিতরটা খুশিতে ভরে উঠেছিল। বুকের ভিতর একরাশ খুশি আর হাতে প্রেগনেন্সির রিপোর্টটা নিয়ে আজ একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরছিল সে। অনেকদিন পর অপেক্ষা করেছিল সলিলের জন্য। প্রথম খবরটা তাকেই দিতে চেয়েছিল সে। কিন্ত জীবনের পথে সব সময়ই যে সাজিয়ে রাখা হিসাব গুলো মিলে যায় তা কিন্ত নয়!
পৌলমীর ক্ষেত্রেও তা হল না। সলিল অফিস থেকে ফিরেই , বিনা ভূমিকায় শুরু করল,
” কি , তোমার ফস্টিনস্টি মিটল? কি ভেবেছিলে আমি কিছু জানতে পারব না ? অফিসে হাফ ডে নিয়ে বাইরে ফুর্তি করে বেরাবে? আজ হাতেনাতে ধরে ফেলেছি !
খুব দুজনে হেসে ফুচকা খাওয়া হচ্ছিল! তাই না ! সাথে সাথেই তোমার অফিসের শর্মিলাদিকে ফোন করে জেনেছি , ব্যাক্তিগত দরকার আছে বলে হাফ ডে করে বেরিয়ে পড়েছিলে অফিস থেকে! তা এমন কতদিন চলছে !!”
পৌলমী এতক্ষন চুপচাপ শুনছিল। এবার বুঝতে পারল ব্যাপারটা। পৌলমী আজ ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরতেই দেখা হয় ঋষির সাথে । ঋষি পৌলমীর কলেজ ফ্রেন্ড। ঋষির বৌও প্রেগনেন্ট । ঋষি তার বৌয়ের রিপোর্ট দেখাতে এসেছিল ডাক্তারকে। একাই এসেছিল।
পৌলমীকে ওখানে দেখেই গুড নিউজ আন্দাজ করে সে। আর দুই বন্ধুর গুড নিউজ সেলিব্রেট করতেই এই ফুচকা ট্রিট। ঠিক কলেজের মতো । আর সেটাই কোনভাবে দেখেছে সলিল তাই এই আস্ফালন। সলিলের কথা বলা এখনও থামে নি। পৌলমীর চোয়ালটা ক্রমেই শক্ত হয়ে যাচ্ছে। যে খবরটা দেওয়ার জন্য এতক্ষন অপেক্ষারত ছিল সে, সেটা আর দিতে ইচ্ছা করছে না। আজ আর কোন সাফাই দিতেও মন সরছে না তার। তার জায়গায় মনের ভিতর অন্য চিন্তা বাসা বাঁধছে। খুব ইচ্ছা করছে সীমাবদ্ধতার গণ্ডিটা এক লাফে পেরিয়ে যেতে। আজ পৌলমীর সব ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে।
সকালে উঠে পৌলমীকে না দেখতে পেয়ে সলিল খুব একটা বিচলিত বোধ করে নি। কাল রাতের অশান্তিটা এখনও চলছে তার মনের ভিতর। এত বড় অভিযোগের পর পৌলমীর চুপ করে থাকাটা সলিল নিজের ভাবনার সত্যতার প্রমাণ বলে মনে করে। কিন্ত সন্ধ্যার সময় যখন বাড়ি ফিরে মায়ের কাছ থেকে জানতে পারে যে পৌলমী তার বাপের বাড়ি যায় নি , তখন একটু বিচলিত হয়ে পড়ে সে। সলিলের মা পৌলমীর মাকে ফোন করেছিলেন মেয়ের কার্য কারিতা সম্পর্কে জানিয়ে দুটো কথা শোনাবেন বলে আর তখনই জানতে পারেন সেখানে পৌলমী নেই। সলিল এরপর অন্তত দশবার ফোন করেছে পৌলমীকে কিন্ত কোন উত্তর নেই। তাতে আরও রেগে গেছে সলিল । আজ বাড়ি ফিরলে পৌলমীকে দেখে নেবে সে , এইভেবেই রাগে ফুঁসছে ।
বেশ কিছুক্ষণ পর পৌলমীর ফোন থেকে একটা ম্যাসেজ ঢোকে সলিলের ফোনে ,
“সলিল , তোমার সাথে চার বছর সংসার করে আমি উপলব্ধি করেছি যে , অতিরিক্ত পসেসিভনেস কখনও গর্বের হয় না বরং অপমানের হয়। তোমার আমার প্রতি বিশ্বাসের কমতি আছে বলেই না আমাকে নিয়ে পসেসিভ হওয়ার এত বাড়াবাড়ি ! যাক সেসব কথা , আমি আজ অন্য কিছু বলতে চাই। আমি অফিস থেকে ট্রান্সফার নিয়ে নিচ্ছি খুব তাড়াতাড়িই। আমি অনেক চেষ্টা করে সব সীমাবদ্ধতার বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে এসেছি তোমার খাঁচা থেকে । হ্যাঁ , খাঁচাই বটে , যেখানে নিজের মতো বাঁচা যায় না , কারও নজর বন্দি হয়ে থাকতে হয়, যেখানে পদে পদে অবিশ্বাস আর সন্দেহের কাঁটা সেটা কি খাঁচার থেকে কম কিছু !
আগেও যে মনে হয় নি তা নয়, তবে , লোকে কি বলবে ! সমাজ আমাকে কি ভাবে দেখবে! এমন নানা প্রশ্ন উঠেছিল মনে আর সেই ভয়ে পিছিয়ে এসেছিলাম। কিন্ত না , আজ আমার আর সেসব ভয় করছে না । আমি যে আর একা নই তাই মনের সাহসটাও বেড়ে গেছে। হ্যাঁ , আমি মা হতে চলেছি। জানি, পিতৃ পরিচয় নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে তোমার! তবে এই সন্দেহটা থাক । তুমি সারা জীবন এই সন্দেহের আগুনে তিল তিল করে জ্বলতে থাক । এটাই তোমার শাস্তি। একে যদি তোমার সন্তান বলে মনে কর তবুও তাকে তুমি কাছে পাবে না , আর যদি অন্য কারও সন্তান ভাব তবুও পরাজয় তোমারাই হল । উভয়ক্ষেত্রেই হার তোমার। আমাকে আর অযথা ফোন করো না । আর জানার চেষ্টাও করো না আমি কোথায় আছি বা ভবিষ্যতে কোথায় থাকব । ডিভোর্স পেপার ঠিক সময় পৌঁছে যাবে তোমার কাছে ।”
ম্যাসেজটা পরে মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে সলিলের। একবার মনে হচ্ছে পৌলমীর গর্ভের সন্তান তারই , আজই তাকে খুঁজে নিয়ে আসবে সে কিছুতেই যেতে দেবে না নিজের সন্তান কে নিজের থেকে দূরে । আবার মনে হচ্ছে সেই লোকটার কথা যার সাথে হেসে হেসে ফুচকা খাচ্ছিল পৌলমী । মনে পড়ছে আগের রাতে হাজার অভিযোগেও পৌলমীর চুপ করে থাকা ! সলিলের ভিতরটা জ্বলতে থাকে । নিজের বোনা সন্দেহের চোরাবালিতে ক্রমেই ডুবতে থাকে সে । নিজের মনের সীমাবদ্ধতা আর সংকীর্ণতা কুরে কুরে খেতে থাকে তাকে।